কেমন ছিলেন বিখ্যাত লেখকেরা? তাদের সাফল্যের পিছে চাবিকাঠিই বা কী ছিলো? অনেকেরই এই ব্যাপারে অনেক কৌতূহল কাজ করে। বিখ্যাত লেখকদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরণ তাহলে একনজরে দেখে নেয়া যাক আজকের এই লেখার মাধ্যমে। এতে যেমন তাদের সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন, একইসাথে আপনার যদি লেখালেখির প্রতি ঝোঁক থাকে, তাহলে ভালো লেখক হতে হলে দৈনিক রুটিনটা কেমন হওয়া উচিত সেই সম্পর্কেও ধারণা পাবেন।
ই. বি. হোয়াইট
একটি সাক্ষাৎকারে ই বি হোয়াইট বলেন,
“আমি কাজ করার সময় কখনোই গান শুনি না এবং আমি অতটা পছন্দও করি না। কোনো ধরনের মনোযোগে ব্যাঘ্যাত ঘটায় না এমন পরিবেশে আমি কাজ করতে ভালোবাসি। আমাদের বাসার লিভিং রুমটি আমি অধিকাংশ সময়ই ব্যবহার করে থাকি লেখালেখির জন্য। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আমার পরিবারের মানুষজন আমি যে একজন লেখক সে বিষয়টায় গুরুত্বই দেয় না। আমাদের লিভিং রুমে এবং এর বাইরে সবসময়ই তাদের আওয়াজ, চিল্লাপাল্লা লেগেই থাকে। আমার যখন আওয়াজ সহ্য হয় না তখন আমি নিরিবিলি কোথাও চলে যাই।”
যেকোনো পরিবেশেই নিয়মিত লেখার অভ্যাসটা তিনি চালিয়ে যান। বিখ্যাত এই লেখকের মতে, যে লেখক লেখারলেখির জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করেন তার পক্ষে কাগজে একটা শব্দ লেখাও কঠিন। লেখার পরিবেশ নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
জর্জ প্লিম্পটনের সাথে এক সাক্ষাতকারে কালজয়ী এই লেখক জানিয়েছিলেন, যখন একটি বই কিংবা উপন্যাস লেখার কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন তিনি প্রতিদিন একদম ভোরবেলাতে লেখা শুরু করেন। কারণ তখন লেখার কাজে ব্যঘ্যাত ঘটানোর জন্য কেউ থাকে না এবং ভোরের সজীব পরিবেশে মাথা ঠান্ডা থাকে। তাই ব্রেইনও ভালো কাজ করে।
তিনি ততক্ষণ লিখতে থাকেন যতক্ষণ তার মনে হয় লেখায় রস আছে এবং একে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তিনি ভোর ৬টা থেকে দুপুর পর্যন্ত লেখার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। তবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো লেখা চালিয়ে যান না। যখন মনে হয় থামা উচিত, তখন বিরতি নেন এবং পরের দিন যেখানে বিরতি নিয়েছিলেন সেখান থেকেই শুরু করেন আবার।
হারুকি মুরাকামি
বিখ্যাত পত্রিকা গার্ডিয়ানের জরিপ অনুযায়ী, সেরা জীবিত লেখকদের মধ্যে প্রথম সারিতেই আছেন হারুকি মুরাকামি। ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় দৈনিক রুটিন নিয়ে। উত্তরে তিনি জানান, তিনি যখন লেখালেখির মেজাজে থাকেন তখন ভোর ৪টায় ওঠেন এবং ৫-৬ ঘন্টার মতো লেখেন। এরপর বিকেলে তিনি ১০ কিলোমিটারের মতো হাঁটেন অথবা ১,৫০০ মিটারের মতো সাতার কাটেন!
তারপর তিনি কিছুক্ষণ বই পড়েন ও গান শোনেন এবং ৯টায় ঘুমাতে যান। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই তিনি প্রতিদিন এভাবেই কাটান। মুরাকামি মনে করেন, পুনরাবৃত্তি একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। চেতনার গভীর স্তরে পৌঁছাতে এটা অনেক সাহায্য করে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের জন্য এরকম নিয়মমাফিক জীবনযাপনের জন্য মানসিক এবং শারীরিকভাবে অনেক শক্ত হতে হয়।
সুসান সন্ত্যাগ
জনপ্রিয় ‘অন ফটোগ্রাফি’র লেখিকা সুসান সন্ত্যাগের ডায়েরি থেকে তার জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি সবসময়ই সকাল ৮টার আগে ঘুম থেকে উঠতেন। মাঝে মধ্যে সপ্তাহে ১ দিন হয়তো এর ব্যতিক্রম ঘটতো। তার স্বামী রজারের সাথেই তিনি প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতেন।
সুসান নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তার ডায়েরি থেকে আরও জানা যায়, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি প্রচুর বই পড়তেন যাতে কম লিখলেও চর্চায় সমস্যা না হয়। তিনি সপ্তাহে একদিন চিঠির জবাব লিখতে বসতেন।
মায়া এঞ্জেলো
২০১৩ সালে দ্য ডেইলি বিস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত আমেরিকান লেখিকা মায়া তার দৈনিক রুটিন নিয়ে কথা বলেন। সেখান থেকে অনেক মজার তথ্য বেরিয়ে আসে।
যেমন- তিনি তার শহরেই একটা হোটেলে রুম ভাড়া করেছিলেন। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ছ’টায় তিনি সেখানে যেতেন। বেডরুমে একটি বিছানা, টেবিল এবং বাথরুম ছিলো। তিনি সেখানে ডিকশনারি, বাইবেল, এক প্যাকেট তাস এবং কিছু ক্রসওয়ার্ড পাজল রাখেন। ছোটবেলায় তার দাদীর কাছ থেকে তিনি ধারণা পান মানুষের দুটো মাইন্ডের- ‘বিগ মাইন্ড’ এবং ‘লিটল মাইন্ড’। মায়া মনে করেন, বিগ মাইন্ড আমাদের গভীর চিন্তা করতে সাহায্য করে এবং লিটল মাইন্ড মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই লিটল মাইন্ডের পরিচর্যার জন্য তিনি তাস কিংবা পাজল খেলতেন, যাতে বিগ মাইন্ড উপন্যাস নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে।
অ্যালিস মুনরো
নোবেলজয়ী ছোটগল্প লেখিকা মুনরোকে ১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
“আমি প্রতিদিন সকালে লিখি, সপ্তাহে সাতদিন। মোটামুটি সকাল ৮টার দিকে লেখা শুরু করি এবং প্রায় ১১টা পর্যন্ত লিখি। প্রতিদিন কত পৃষ্ঠা লিখবো তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখি। প্রতিদিন আমি কী পরিমাণ হাঁটবো সেটাও নির্দিষ্ট। আমি প্রতিদিন প্রায় ৩ মাইল হাঁটি এবং কোনো কারণে যদি একদিন হাঁটতে না পারি তাহলে আমি সেটা পরে পুষিয়ে নেই। আমি আমার বাবাকেও একই নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি।”
সিমোন ডি বিভয়ের
১৯৬৫সালে একটি সাক্ষাতকারে বিখ্যাত ফরাসি লেখিকা সিমোন কাজ এবং জীবনে কীভাবে ভারসাম্য রাখেন তার কৌশল বলেন। তিনি সকালে এক কাপ চা খেয়ে সকাল ১০টার দিকে লিখতে বসেন এবং প্রায় ১টা পর্যন্ত লেখেন।
এরপর তিনি তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যান। ৫টার দিকে আবার লিখতে বসেন এবং ৯টা পর্যন্ত লেখেন। তিনি আরও জানান, সন্ধ্যার দিকে তিনি মুভি দেখতে যান এবং নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে রেডিও শোনেন।
বিখ্যাত লেখক লেখিকাদের দৈনিক রুটিন থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাদের তৈরি করা রুটিন অনুযায়ী তারা প্রতিদিন কাজকর্ম করতেন এবং লেখালেখির পাশাপাশি তারা সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামও করতেন। তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সময় দিতেন। এ থেকে আমরা একটা জিনিস বুঝতে পারি, কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অনেক ছোট ছোট বিষয়কেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।